
লেখক: ফেরদৌস পরশ, জাতীয় ফোরাম সদস্য ও আহবায়ক, নাগরিক ঐক্য, যশোর জেলা শাখা।
সম্পাদকীয় নোট: জুলাই সনদ ২০২৫ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন ধারার সূচনা করেছে। কিন্তু সনদ স্বাক্ষরের পরও এর ৮৪টি ধারার আইনি বৈধতা এবং বিভিন্ন দলের দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) বড় প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। নাগরিক ঐক্যের জাতীয় ফোরামের সদস্য ও যশোর জেলা শাখার আহবায়ক, ফেরদৌস পরশ তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে আলোচনা করেছেন কীভাবে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ’ এবং গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্বকে সাংবিধানিক সংস্কারের পথে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে। তাঁর মতে, এই গণভোটই হবে জাতির জন্য চূড়ান্ত পরীক্ষা।
সম্প্রতি জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা আমার জন্য এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। নাগরিক ঐক্যের প্রতিনিধি হিসেবে, বিভিন্ন দলের নেতৃত্বের সঙ্গে আমি সনদের ৮৪টি ধারার গভীরতা, এর নোট অব ডিসেন্ট এবং ভবিষ্যতের বাস্তবায়ন কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছি। এই ব্যাপক সংস্কারের পথে ঐকমত্য যেমন এসেছে, তেমনি রয়ে গেছে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ।
১. 🤝 ঐকমত্যের ভিত্তি: মৌলিক সংস্কারের প্রধান ধারাগুলো
জুলাই সনদের ৮০ শতাংশের বেশি প্রস্তাবনা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মৌলিক ঐকমত্য দেখা গেছে, যা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আমূল পরিবর্তন আনবে। এর প্রধান অর্জনগুলো হলো:
ক্ষমতার ভারসাম্য (ধারা ১৪, ১৫): প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ নির্ধারণ এবং একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান না থাকার বিধান এই সনদের অন্যতম অর্জন। এটি অতীতের এককেন্দ্রিক ক্ষমতা রোধে অপরিহার্য।
স্বাধীন ও পেশাদার প্রতিষ্ঠান: সনদে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করার জন্য সচিবালয় তৈরি এবং স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের মতো মৌলিক বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হয়েছে।
সংবিধানের মূলনীতি (ধারা ৬): সংবিধানের মূলনীতিতে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ যুক্ত করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় ফিরে যাওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে।
আইনসভা ও জবাবদিহি: সংসদে স্থায়ী কমিটিগুলোতে বিরোধী দল থেকে সভাপতি করার বিধান কার্যকর করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।
২. 📢 ভিন্নমতের রাজনীতি: নোট অব ডিসেন্ট ও তার প্রভাব
৮৪টি ধারার মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ ধারায় বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে শক্তিশালী নোট অব ডিসেন্ট এসেছে, যা সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে। এই ভিন্নমতগুলো মূলত দুটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত:
সাংবিধানিক কাঠামোগত পরিবর্তন: এর প্রধান উদাহরণ হলো দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রস্তাব। কিছু দল এই সংস্কারের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে। তাদের যুক্তি হলো—বাংলাদেশের বাস্তবতায় উচ্চকক্ষের প্রয়োজন নেই এবং এটিকে তারা বাড়তি খরচ হিসেবে দেখছেন। একইভাবে, সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ন্যায়পাল (Ombudsman) নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়েও কিছু দল আপত্তি জানিয়েছে।
রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নির্বাচনী পদ্ধতি: তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের স্তর নির্ধারণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে একাধিক দল আপত্তি জানিয়েছে। তাদের দাবি হলো—এই সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচিত সংসদের হাতে থাকা উচিত।
এই ভিন্নমতগুলো জুলাই সনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। এখন সনদের মাধ্যমে ঐকমত্যের মধ্যে ভিন্নমতকেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ভিন্নমত পোষণকারী দলগুলো তাদের এজেন্ডা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করবে, এবং জনগণ ম্যান্ডেট দিলে সেই অনুযায়ী সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারবে।
৩. ⚖️ আইনি চ্যালেঞ্জ: ‘জুলাই আদেশ’ ও গণভোটের অনিবার্যতা
৮৪টি ধারার আইনি বৈধতা নিশ্চিত করতে ঐকমত্য কমিশন যে কৌশল নিয়েছে, তা নিয়ে আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। সনদের নৈতিক অঙ্গীকারকে আইনি বাধ্যবাধকতায় রূপান্তর করতে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’ জারির প্রস্তুতি চলছে।
গণভোটের মাধ্যমে বৈধতা: আদেশটির ওপরই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। জনগণের সার্বভৌম কর্তৃত্বের প্রয়োগ দেখিয়ে সাংবিধানিক জটিলতা কাটাতে এটি একটি অভিনব প্রচেষ্টা। গণভোটে আদেশটি অনুমোদিত হলে, এটি পরবর্তী নির্বাচিত জাতীয় সংসদের জন্য সংবিধান সংশোধন বাধ্যতামূলক করে দেবে।
সময় ও পদ্ধতিগত বিতর্ক: গণভোটের সঠিক সময় নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক রয়েছে। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করার পক্ষে থাকলেও, অন্যান্য দল দ্রুত গণভোট চায়। এই পদ্ধতিগত অস্পষ্টতা দূর করা না গেলে গণভোটের সাফল্য ব্যাহত হবে।
৪. 🧭 উপসংহার: জনগণের সার্বভৌমত্বের চূড়ান্ত পরীক্ষা
জুলাই সনদ ২০২৫ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন ধারার সূচনা করেছে। এই দলিলকে সফল করতে হলে, ‘জুলাই আদেশ’ দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে প্রণয়ন করে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত ম্যান্ডেট নিতে হবে। এই ৮৪টি ধারার বাস্তবায়নই নির্ধারণ করবে—বাংলাদেশ দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে একটি স্থিতিশীল ও জবাবদিহিমূলক শাসনকাঠামোর দিকে এগোবে, নাকি আবার পুরোনো বিভাজনের ফাঁদে পড়বে। এটিই হবে জনগণের সার্বভৌমত্বের চূড়ান্ত পরীক্ষা।